ইস্তাম্বুল বা কন্সট্যান্টিনোপল
ইস্তাম্বুল বা কন্সট্যান্টিনোপল
গভীর তন্ময়তা নিয়ে তাকিয়ে আছি দূরের সুলতান আহমদ মসজিদের মিনারচুড়োর লাল আলোর দিকে। ধীরেধীরে আমার চোখের সামনে থেকে মুছে গেলো আলোপ্লাবিত আধুনিক ইস্তাম্বুলের ছবি। জেগে উঠল দূর অতীতের ইস্তাম্বুল। ভাগ্যবিড়ম্বিত সুলতান আব্দুল হামীদের ইস্তাম্বুল। সুলতান মুরাদ, সুলতান সেলিম ও সোলায়মান আলকানুনীর ইস্তাম্বুল; সুলতান আহমদের ইস্তাম্বুল, যার মসজিদের মিনারচুড়ার লাল স্বপ্নিল আলো আমাকে নিয়ে চলেছে দূর অতীতের অভিযাত্রায়।
একসময় দেখতে পেলাম ইস্তাম্বুল নয়, কন্সটান্টিনোপল, যার নগর দরজায় হামলা শুরু করেছেন সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ। ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে আমি যেন দেখতে পাচ্ছি সুলতানের শান্তসৌম্য মুখমণ্ডল।
ফজরের জামাতে তিনিই হলেন ইমাম। মুনাজাত শেষে মুজাহিদিনের উদ্দেশ্যে ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণে ঘোষণা করলেন, ইনশাআল্লাহ ইস্তাম্বুল জয় করে আজকের যোহর আমরা আদায় করবো আয়াসুফিয়ায়।
চূড়ান্ত হামলার আগে মহান সুলতান এই বলে সন্ধিপ্রস্তাব পাঠালেন, আত্বসমর্পণ করো, আমি ওয়াদা করছি, তোমাদের জানমাল, ইজ্জত-আবরু এবং ধর্ম ও ধর্মস্থান নিরাপদ থাকবে।
ইতিহাসের পাতায় এ রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে যে, কী কারণে এমন নাযুক পরিস্থিতির মুখেও এমন একটি উদার সন্ধিপ্রস্তাব বাইজান্টাইন সম্রাট প্রত্যাখ্যান করে বসলেন! একেই হয়ত বলে নিয়তি যা রদ হয় না।
সময়ের প্রাচীর এবং ইস্তাম্বুল নগরের প্রাচীর যেন একই সঙ্গে ধ্বসে পড়ল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ভাঙ্গা প্রাচীরের আড়ালে নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়েও বাইজান্টাইন বাহিনী অর্থহীন সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করছে। লড়াই করছে আর গোলার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহের মুখে তখন সেই শান্ত স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল যা প্রত্যেক বীর বিজয়ীর মুখেই ইতিহাস দেখতে পায়।
এ সেই ইস্তাম্বুল যার বিজয়ের ব্যাপারে নবী মুহাম্মদ সা. ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর, বহু আক্রমণের পর ২২ বছরের এক তেজোদৃপ্ত যুবক মুহাম্মদ আল ফাতিহের হাতে বিজয় হল।
উপরের কাহিনীটা শুধুমাত্র মুসলমানদের ইস্তাম্বুল বিজয়ের খসড়া রুপ বলা যেতে পারে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় তৎকালিন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপল জয় করতে পুড়তে হয়েছে অনেক কাঠখড়, অনেক উত্থান পতনের পর সবশেষে যখন মুহাম্মদ আল ফাতিহ কন্সটান্টিনোপল অবরোধের প্রস্তুতি শেষ করলেন তিনিও দেখলেন একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে। মূলত এর আগের সব আক্রমণই প্রতিহত হয়েছে কোন না কোন ভুল এবং কন্সটান্টিনোপলের মজবুত প্রাচীরের কারণে।
এ প্রাচীর এমনিই মজবুত ছিল শতশত কামানের গোলাতেও যার গায়ে ফোটো পরিমাণ ছিদ্র করা যায়নি। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ এই প্রাচীর টপকানোর জন্য বানিয়েছিলেন এক অত্যাধুনিক কামান যা সেসময়ের বিশ্ময়কর আবিষ্কার ছিল।
ভুলটা করেছিলেন শহরে ঢুকতে নৌ বন্দরের আগে গোল্ডেন হর্ণে খ্রিষ্টানরা বিরাট শিকল দিয়ে আটকে দিয়েছিল যার কারণে জাহাজ আটকে যেত এবং ডুবে যাওয়ার সম্মুখীন হয়ে পড়ত। আর এ ব্যাপারে সুলতান কোন প্রস্তুতিই রাখেননি। কিন্তু তিনি উপস্থিত বুদ্ধিতে এমনিই এক উপায় বের করলেন যা মনে করে আজও খ্রিষ্টানরা আফসোস করে।
সুলতান কিভাবে শেই শিকল পার হয়েছিলেন তা ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে আজও প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে জ্বলজ্বল করে।
এবার মূল কথায় আসি, লেখক, ইসলামি গবেষক আবু তাহের মেসবাহ এক সম্মেলনে তিনদিনের সফরে তুরস্কে ভ্রমণ করেন। তারই প্রেক্ষিতে বই আকারে এখন আমাদের সামনে হাজির 'তুরস্কে তুর্কিস্তানের সন্ধানে" নামক তার ছোট্ট সফরনামা। সময় হিসেবে তিনদিন হয়তো অল্প সময় কিন্তু এরই ভেতর লেখক ৩০০ পৃষ্ঠার বিরাট এক বই লিখেছেন। যদি বলা হয় সাহিত্যে রসবোধ ১০ প্রকার তাহলে ১০টি প্রকারেই তার লেখনীর জবানীতে উঠে এসেছে বিভিন্ন ইতিহাস। একেবারে শুরু থেকে উসমানী সালতানাত, উসমানী খেলাফতের সুলতান যারা এক সময় এই ইস্তাম্বুলেরই মাটিতে বসে এক সময় দৌর্দন্ড প্রতাপে বিশ্ব শাসন করেছে। একদিকে তাদের কাহিনী যেমন হৃদয়ের প্রস্ফুটিত কালিতে লেখক বুনন করেছেন , অন্যদিকে অন্তরের আকুতি মিশিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন ইস্তাম্বুলের বর্তমান, ভবিষ্যৎ, আয়াসুফিয়া, সেন্ট সুফিয়া, তোপকাপে মিউজিয়াম, বিভিন্ন মসজিদ ( এখন নাম মনে আসছে না) বসফরাস, বারবোসা, আনাতোল দূর্গ, রোমেল দুর্গ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, তার বাল্যকাল, যৌবনকাল, তুরস্কের বর্তমান রাজনীতির হাল হাকিকত, ইস্তাম্বুলের আধুনিক রুপ আরো কত কী! বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না।
বইটি পড়ার আগে বুঝতেই পারিনি একটা শহর বা একটা দেশ নিজের চোখে না দেখেও এত বুঝা যায়, ভালোবাসা যায়!
এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র পর্যটকের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গী থাকার কারণেই। এবং প্রতিটি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ সুন্দর বর্ণনায় তুলে ধরার মানসিকতাতেই। এত বিশদ আলোচনা সত্তেও বিরক্ত হবার কোন উপায় নেই। বরং এক আশ্চর্য মুগ্ধকর বিশ্ময়ে পড়লাম আর বারবারই আবেগে কান্নায় চোখের কোন ভিজে উঠছিলো নিজের অজান্তেই। আমার পাঠক জীবনে এটাই একমাত্র বই যা পড়ে আবেগে সবচে বেশী কেঁদেছি।
এ কান্না লেখনীর সৌন্দর্য্যের! এ কান্না তুর্কিস্তান হারানো এক মুসলিমের! এ কান্না সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহের ইস্তাম্বুল বিজয়ের! এ কান্না অতীত গৌরব হারানো অনেকের! এ কান্না আমার আনন্দের!!!
এক নজরে বই :
বই : তুরস্কে তুর্কিস্তানের সন্ধানে
লেখক : আবু তাহের মেসবাহ
প্রকাশনী : দারুল কলম
প্রচ্ছদ : মুহাম্মদ
পৃষ্ঠা : ৩০৭
মলাট মূল্য : ১৫০
No comments