থ্রিলার কী?
প্রথম কথা-
আপনারা যে বলছেন থ্রিলার লেখার পাঠক বেশি, অন্য লেখায় কম এটা বিরাট বড় ভুল। এখনও দেশের সিংহভাগ পাঠক জীবনধর্মী লেখাই পড়েন। থ্রিলার পড়েন খুব কম। তবে থ্রিলার লেখকেরা ফেসবুকে এক্টিভ বলে থ্রিলার পাঠকেরাও খুব একটিভ। এই কারণে ফেসবুকে বিভিন্ন পোষ্ট দেখে মনে হতে পারে থ্রিলারের অনেক বেশি পাঠক। আসলে মোটেই তা নয়! ফেসবুক দিয়ে আপনি গোটা দেশের পাঠককে জাজ করতে পারবেন না! বইয়ের রেগুলার পাঠকের বড় একটা অংশ ফেসবুকে বইপড়া বিষয়ে কথা বলেন না। প্রতি বছর বইমেলায় যে বইগুলো টপ সেলিং লিস্টে থাকে তার মদ্ধ্যে থ্রিলার এর সংখ্যা অতি নগন্য। বাইরের দেশে এখন থ্রিলার পাঠকের সংখ্যাই বেশি, কিন্তু বাংলাদেশে এখনও সে অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। এদেশে হাতে গোনা অল্প কজন লেখক থ্রিলার লেখেন। আর বড়জোর ৭-৮টা প্রকাশনী আছে যারা রেগুলার থ্রিলার বই ছাপায়। বাকিরা এখনও সামাজিক উপন্যাসকে প্রাধান্য দেন। মোট প্রকাশিত বই, লেখক আর প্রকাশনী হিসেব করলে থ্রিলার সেখানে খুবই কম! এটা আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। লেখক - প্রকাশকদের বিভিন্ন গেট টুগেদারে গিয়ে আমি দেখি যে সেখানে আমি ব্যতিত অন্য কোন থ্রিলার লেখক নেই!
দ্বিতীয় কথা-
থ্রিলার ভাল না সামাজিক উপন্যাস ভাল, এই কথাটার অর্থ আসলে কি? থ্রিলার কি অসামাজিক উপন্যাস? থ্রিলার কি সমাজের বাইরের কিছু? সামাজিক নাকি থ্রিলার? এই প্রশ্নটা হাস্যকর নয় কি? থ্রিলার সামাজিক উপন্যাসেরই বিশেষ এক ধরণের স্টাইল। একই উপন্যাস স্বাভাবিক দৃষ্টিকোন থেকে লিখলে সাধারণ জীবনধর্মি উপন্যাস হবে, সেটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে লিখলে হয়ে যাবে থ্রিলার।
একটা উদাহারন দেই-
ধরুন, আমি এমন একটা গল্প লিখলাম যেখানে একটা বাচ্চা স্কুল থেকে কোন টুরে গিয়ে দলছুট হয়ে হারিয়ে গেল। সামহাউ সে অনেক দূরে চলে গেল, আর ফিরতে পারলো না। এর পর সে এখানে ঘুরছে, ওখানে ঘুরছে, অনেক কষ্ট করতেছে। এদিকে সন্তান হারিয়ে মাতা বিলাপ করছে। পিতা তাকে হন্যে হয়ে খুজতেছে। এইভাবে অনেক বাঁধা অতিক্রম করে ছেলেটা অবশেষে ঘরে ফিরে আসলো। শেষ দৃশ্যে মা ছেলের মিলন। পাঠকের চোখে পানি। ব্যাস! হয়ে গেল খুব চমৎকার একটা জীবনধর্মী উপন্যাস। এমন একটা লেখা পড়তে সবার ভাল লাগবে। আমারও লাগবে।
কিন্তু একটু ঘুরিয়ে লিখতে এটাকে একটা থ্রিলার উপন্যাস করা যায়। ধরুন বাচ্চাটা স্কুল থেকে ফেরার সময় কিডন্যাপ হল। সামহাউ সে পরে কিডন্যাপারদের হাত থেকে পালিয়ে গেল। এখন থাকবে কই? খাবে কি? সামাজিক উপন্যাসে কেবল ছেলেটার দুঃখ কষ্ট থাকবে, খেতে পারছে না, ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু থ্রিলারে এইসবের পাশাপাশি তার এডভেঞ্চারাস কার্যক্রম দেখানো হবে। সে চুরি চামারি করতে শুরু করলো। চুরি করা, দৌড়ে পালানো এই দৃশ্যগুলোর বর্ণনাতে দারুণ এক্সাইটমেন্ট দেখাতে হবে। লেখকের জন্য চ্যলেঞ্জটা হোল- লেখার স্টাইলে ফুটে উঠতে হবে থ্রিল। ধরেন, এর পর সে আস্তে আস্তে টোকাইদের দেখে ধান্দাবাজি, গাঁজা বিক্রি এই ধরণের খারাপ কাজের সাথে জড়িয়ে গেল। তারপর তার যায়গা হল সন্ত্রাসীদের ডেরায়। একসময় সে বুঝতে পারলো এই লাইফ তার নয়, সে শিক্ষক পিতার সন্তান, বাবা তাকে এই শিক্ষা দেয়নি। একদিন ছেলেটা বুদ্ধির খেলা খেলে সন্ত্রাসী দলটাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পালালো। পালানোর পর এবার তো বাড়ি ফিরবে! কিন্ত এখানে সামাজিক উপন্যাস এর সাথে থ্রিলারে একটা পার্থক্য থাকে। থ্রিলার উপন্যাস অসম্পূর্ণ থেকে যায় কাহিনীতে একটা টুইস্ট না থাকলে। এদিকে তার পরিবারে দেখা যাবে ছেলেকে হারানোকে কেন্দ্র করে তার পিতা মাতার মধ্যে বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে। পিতা হয়তো ছেলে হারানোর ঘটনা তদন্ত করছিলেন, যার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসবে পরিবারের অনেক অজানা কাহিনী, সামাজিক চক্রান্তের জাল। জানা যাবে ছেলেটাকে কিডন্যাপের পেছনে হাত ছিল পরিবারে কাছের কারো, হয়তো ছেলের মায়েরই, অথবা সমাজের উচু শ্রেণীর কারো যাকে সবাই ভাল জানে। কিডন্যাপের উদ্দেশ্য হয়তো বা খারাপ ছিল না, কিন্তু ছেলেটা পালিয়ে যাওয়ার সব গুবলেট হয়ে গেল। তবে প্যাচ লাগালেই হবে না, সব শেষে একটা দারুণ ফিনিশিং দিতে হবে। তাহলেই অসাধারন একটা থ্রিলার উপন্যাস হয়ে যাবে।
এখন কথা হচ্ছে- দুইটা উপন্যাসে পার্থক্যটা কই? সামাজিক উপন্যাসে কেবল দেখানো হয়েছে খালি চোখে যা দেখা যায়, সেই সব বিষয়। আর থ্রিলারে খালি চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তার পাশাপাশি ঘটনার আড়ালের ঘটনা তুলে আনা হচ্ছে। আপনি হয়তো শুধু সাদা মনে সাদা কাহিনী পড়ে খুশি হতে পারছেন, কিন্তু সাদার অপর পিঠে যে কালো আছে সেটা কি আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন? আপনি সমাজের ডার্কনেসের কথা লিখছেন না, তারমানে এই নয় যে সমাজে ডার্ক কিছুই নেই! সামাজিক উপন্যাস মানুষের সাদা মাটা জীবন যাপন- কষ্ট- সুখ-প্রেম আর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। থ্রিলারে উঠে আসছে সেই একই জীবনের আরেক রুপ। সেটা বাস্তবের বাইরে কিছুই নয়।
আমি অনেক পাঠক পাই যারা বলেন যে তারা থ্রিলার পড়েন না। থ্রিলার পড়তে ভাল লাগে না। আমার সন্দেহ আসলে তারা থ্রিলার কয়টা পড়েছেন? থ্রিলারের অনেক সাব জনরা আছে। তারা হয়তো এক ধরণের থ্রিলার পড়েছেন যা তাদের ভাল লাগেনি, সবার সব কিছু ভাল লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য জনরাগুলো হয়তো তাদের ভাল লাগতো। না পড়লে সেটা বুঝার উপায় কি? ফ্যান্টাসি থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন থ্রিলার, রহস্য উপন্যাস, হরর ধাঁচের থ্রিলার, এডভেঞ্চার, হিস্টোরিক্যাল আরও কত কি! আমার লেখা প্রথম উপন্যাস ইনকারনেশন ছিল সায়েন্স ফিকশন ধাঁচের থ্রিলার, ব্লাডস্টোন আর স্কারলেট ছিল হিস্টোরিক্যাল। সেই সব বই যারা পড়েছেন তারা কি দেখেছেন? বইতে কি সামাজিক দিকগুলো ফুটে ওঠেনি? ব্লাডস্টোন ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস ছিল যেখানে মানুষ ভালবাসার জন্য কি করতে পারে সেটা তুলে এনেছি। আর স্কারলেট তো রোমান্টিক থ্রিলারই- ত্রিভুজ প্রেম, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব, আড়াই হাজার বছরের অজানা ইতিহাস। এই উপন্যাস গুলোতে এডভেঞ্চার, রহস্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর চক্রান্তের পার্ট গুলো বাদ দিলে সেটা নির্ভেজাল জীবনধর্মী উপন্যাস হয়ে যেত অনায়াসেই। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে মানুষের জীবনে কোন রহস্য নেই, কখনো যুদ্ধ হয় না কিংবা সমাজে কোন চক্রান্ত হচ্ছে না! আমি লিখছিনা, আপনি পড়ছেন না, তার মানে এই নয় যে সমাজে আসলে তা নেই।
*লেখাটি লিখেছেন লেখক মোঃ-নাজিম-ঊদ-দৌলা
No comments