Header Ads

হৃদয়ের একূল ওকূল

বই : হৃদয়ের একূল ওকূল 
লেখিকা : সাবিহা সুলতানা
বইয়ের ধরণ : রোমান্টিক ছোটগল্প সংকলন
প্রকাশনী:নহলী
পৃষ্ঠা সংখ্যা:৯৬
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
প্রচ্ছদে এম্বোস ও কাগজ : ৮০ গ্রাম পারটেক্স
প্রাপ্তিস্থান :নহলী বুকস
রিভিউ লেখক- তানজিনা তানিয়া
.
শুরুতেই কোনো বইয়ের রিভিউয়ের সাথে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয় এমন দুই একটা কথা বলে নেই।
নতুন প্রকাশনী নহলী ২০১৮ সালের প্রায় পুরোটাই খরচ করেছে অনেক নবীন লেখকের পাঠানো পান্ডুলিপি যাচাই বাছাই করে কোন বইগুলো প্রকাশের যোগ্য সেটা ঠিক করতে। স্বভাবতই বিনামূল্যে বই প্রকাশের এই সুযোগটাকে অনেকেই কাজে লাগাতে চেয়েছে। কিন্তু সফল হয়েছে কয়েকজন মাত্র। সেইজন্য মূলত নহলীর সেই কঠিন বাছাই প্রক্রিয়া পার হয়ে কেমন পাণ্ডুলিপিগুলো প্রেস পর্যন্ত গিয়েছে সেটা জানার জন্য আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। আমার মতো এমন আগ্রহ হয়তো অনেকেরই ছিল।
সেই আগ্রহ থেকেই আমি এখন পর্যন্ত নহলীর প্রকাশিত সাতটি বই সংগ্রহ করেছি এবং পড়েছি। যেগুলো পড়েছি সবগুলোর রিভিউ লেখা শেষ। এখন সপ্তম বইটির রিভিউ লিখতে শুরু করেছি। এই পর্যন্ত পঠিত মোট সাতটি বইয়ের মধ্যে এটির পৃষ্ঠা সংখ্যা সবচেয়ে কম। মাত্র ৯৬ পৃষ্ঠা। যাইহোক, একটা জিনিস আমি এখন পরিষ্কার করে বলতে পারি যে, নহলীর বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই সঠিক হয়েছে। প্রথম বছরেই নহলী যে মানসম্মত বই প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ভবিষ্যতে হয়তো পাঠক বই বা লেখকের নাম দেখে বই কিনবে না। বই কিনবে প্রকাশনীর নাম দেখে। নহলীর নামের উপর বই বিক্রি হবে৷ এখন যেমনটা বাতিঘর প্রকাশনীর ক্ষেত্রে হয়। অনেক পাঠকই বাতিঘরের নামের উপর বই কিনে। যাইহোক, এইবার বই 'হৃদয়ের একূল ওকূল' প্রসঙ্গে চলে যাই।
,
বইটি সাতটি রোমান্টিক ছোট গল্প নিয়ে লেখা। ভালোবাসার বা রোমান্টিক গল্প বলতেই আমরা বুঝি তথাকথিত লুতুপুতু গল্প। কিন্তু হৃদয়ের একূল ওকূল পড়ে বুঝতে পেরেছি রোমান্টিক জনরার গল্প মানেই লুতুপুতু গল্প নয়। বইটিতে সাতটি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে। গল্প সাতটি যথাক্রমে চিঠি, সোনার হরিণ, মুক্তি, সাগরসঙ্গমে, দূরত্ব,জননী, হৃদয়ের একূল ওকূল।
,
বই সার সংক্ষেপ : চিঠি গল্পটিতে একটি মেয়ে তার মায়ের মৃত্যুর পর পাওয়া একটি চিঠি নিয়ে এক মিশনে নামে। তারপর কী হলো? জানতে হলে পড়তে হবে কিছুটা এ্যাডভেঞ্চারধর্মী গল্প 'চিঠি'
,
বড়লোক ঘরে বিয়ে হলেই কি কোনো মেয়ে সুখী হয়ে যায়? এই ব্যাপারটির বাস্তব উদাহরণ "সোনার হরিণ" গল্পটি।
,
মুক্তি গল্পটি একজন অসহায়ের মায়ের গল্প।
,
সাগরসঙ্গমে গল্পটি একটি নিম্নমধ্যবিত্ত দম্পতির সমুদ্র দর্শনের ইচ্ছা নিয়ে লেখা।
,
দূরত্ব গল্পটিতে কিশোর বয়সী সন্তানের সাথে তার বাবা মায়ের দূরত্বের বিষয়টি ফুঁটে উঠেছে।
,
জননী গল্পটি একজন স্ত্রী'র গল্প, যে স্ত্রী বিয়ের পর জানতে পারে তার স্বামীর আগে বিয়ে হয়েছিল এবং সেই পক্ষের একটি মেয়ে আছে।
,
হৃদয়ের একূল ওকূল গল্পটিতে জায়গা পেয়েছে অনেকদিন পর কিশোর বয়সের ভালোবাসার মানুষ হঠাৎ সামনে আসার অনুভূতিকে নিয়ে।
.
পাঠ প্রতিক্রিয়া :
ছোট করে সহজ ভাষায় যদি বলতে যাই তাহলে বলবো বেশ ভালো মানের একটি গল্পের বই 'হৃদয়ের একূল ওকূল'। বইটিতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে হৃদয়ের একূল ওকূল গল্পটি। আচ্ছা কিশোর বয়সের ভালোবাসা কি সত্যি সত্যি ভুলা যায়? প্রথম ভালোবাসা সচেতন মন ভুলে গেলেও বোধহয় অবচেতন মন ভুলতে পারে না। গল্পটি পড়ে অদ্ভুতরকম এক তৃপ্তি পেয়েছি। চিঠি গল্পটি একেবারেই আনকমন থিমে লেখা গল্প। যে গল্পের প্লটই ভিন্নরকম, সেই গল্প চমৎকার না হয়ে পারে না। রোমাঞ্চ সৃষ্টি করার মতো একটি গল্প এটি। মৌলির গল্পটাকে আমার কাছে শুধু গল্প মনে হয়নি। মনে হয়েছে লেখক বাস্তবতাটাকে খুব করে পরীক্ষণ করে তারপর গল্পটি লিখেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ধনী ঘরে বিয়ে হলেই আমরা মনে করি সে অঢেল টাকা পয়সার মধ্যে সুখে থাকবে। কিন্তু ওই যে বিখ্যাত গান আছে, "জীবন নামের রেলগাড়িটা পায় না খুঁজে ইস্টিশন"। গল্পটা পড়ার সময় গানটার কথা মনে পড়ছিলো খুব। মুক্তি গল্পটা সম্পর্কে যদি আমি বলতে যাই তাহলে অনেক কিছু বলতে হয়। সন্তানেরা বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের প্রতি উদাসীন হয়ে যায় এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এই পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে। কিন্তু দৃশ্যপট কি পাল্টে? নাকি বিধবা মায়েরা সন্তানের কাছে আহত হতে হতে মুক্তির জন্য ছটফট করে সদা? গল্পটা পড়ার সময় বার বার দীর্ঘশ্বাস আসছিলো আমার। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল মানুষের চোখে স্বপ্ন বেশি থাকে। অভাব থাকলেও কি স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে? গল্পটি পড়ে নিজেরও সমুদ্র দেখার পুরাতন শখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার। দূরত্ব গল্পটি সকল বাবা মায়েরই পড়া উচিত বলে মনে হয়েছে আমার। সন্তানের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করলেই কেবল দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কিশোর বয়সটাতে সন্তানের সবচেয়ে বড় চাহিদা থাকে বাবা মায়ের সঙ্গ পাওয়ার৷ গল্পটা পড়ে নিজের পুরাতন কিশোরী মনের বিভিন্ন কল্পনা মনে পড়ে গিয়েছিল। জননী গল্পটি বইতে আমার দ্বিতীয় প্রিয় গল্প। এই গল্পের প্লট লেখার স্টাইল সবকিছুই অন্য সব গল্পের থেকে চমৎকার ছিল। বইয়ের প্রত্যেকটি গল্পের নাম যেমন সুন্দর ছিল গল্পগুলোও তার চেয়ে কম সুন্দর ছিল। আমি উপন্যাসের থেকে গল্প পড়তে বেশি পছন্দ করি৷ ছোটগল্প আমার খুবই সুখপাঠ্য বিষয়। কোনো ছোটগল্প আমাকে কাঁদায়, কোনোটি ভাবায় আবার কোনোটি অনাবিল আনন্দে মন ভরে দেয়। এই বইটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ সুখপাঠ্য এই বইটি আমি টানা বশে পড়েছি। একটুও বিরক্তি আসেনি। বইটি কেবল নিছক বিনোদনের খোরাক ছিল না, শিক্ষনীয়ও ছিল বটে৷ মন খারাপের সময় বইটি যে কারোর মন ভালো করে দিতে সক্ষম। লেখকদের লেখায় যেন শিক্ষামূলক কিছু থাকে সেটা নিয়ে সামাজিক যেগাযোগ মাধ্যমে অনেককে কথা বলতে দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষামূলক গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কিন্তু সেইসব গল্পে কোনো প্রাণ থাকে না। প্রথম দুই লাইন পড়ে আর ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। একটি গল্পের প্রথম কয়েকটি লাইনের সম্মোহনী ক্ষমতা প্রবল থাকা উচিৎ, যেই সম্মোহনে সম্মোহিত হয়ে পাঠক গল্পের ভিতরে ঢুকতে চাইবে এবং শেষটা পর্যন্ত জানার আগ্রহ প্রকাশ করবে। এই বইয়ের গল্পগুলোতে সেটা ছিল। বই কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যেই পড়া উচিত নয়। বইতে থেকে জ্ঞান নেওয়ার মতো বা অর্জন করার মতো কিছু থাকতে হয়। এইদিক থেকে বিচার করলে হৃদয়ের একূল ওকূল বইটি মুক্তি, দূরত্ব, জননী গল্পগুলো দিয়ে একইসাথে পাঠকের বিনোদনমূলক ও শিক্ষামূলক দুই চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম।
.
ব্যক্তিগত মতামত : সোনার হরিণ ও মুক্তি গল্প দুইটির থিম কমন ছিল। জননী গল্পটা প্রথমদিকে যতটা আকর্ষণীয় লাগছিল পড়ে আর তেমন লাগেনি৷ এন্ডিংটা আরও ভালো হতে পারতো। সোনার হরিণ গল্পটিতে মৌলি চরিত্রটাকে সর্বোপরি তার অনুভূতিগুলো
আরও স্পষ্ট করে উপস্থাপন করলে গল্পটা আরও চমৎকার হত। ব্যক্তিগত রেটিং ৪.৬/৫।

No comments

Theme images by duncan1890. Powered by Blogger.